Definition and Nature of Biosphere

Definition and Nature of Biosphere {জীবমণ্ডলের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি}
Table of Contents
জীবমণ্ডল (The Biosphere )
জীবনের অস্তিত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই পৃথিবীকে মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহগুলি থেকে পৃথক করেছে। পৃথিবীর শিলামণ্ডলের উপরিভাগ, বায়ুমণ্ডলের নিম্নাংশ এবং সমগ্র বারিমণ্ডল মিলিতভাবে একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল (transitional zone) গঠন করে। এই অঞ্চলটিই হল জীবনের ধারক এবং বাহক। অর্থাৎ এই অঞ্চলেই জীবনের সৃষ্টি এবং অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর জীবন সমন্বিত অংশটিকে সাধারণভাবে জীবমণ্ডল বলা হয়। আয়তনের বিচারে জীবজগতের গুরুত্ব খুব কম হলেও শিলামণ্ডল, বায়ুমণ্ডল বা বারিমণ্ডলের উপর এর প্রভাব যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।Definition and Nature of Biosphere

জীবমণ্ডল বলতে পৃথিবীর জীবীয় বাহ্যাবরণটিকেই বোঝায়। (পূর্বোক্ত পরিবর্তনশীল অঞ্চল জীবমণ্ডলকে ধারণ করে এবং জীবমণ্ডলের সাথে অবিরত পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। জীবমণ্ডল সহ এই পরিবর্তনশীল অঞ্চলটিকে একত্রে বাস্তুমণ্ডল (ecosphere) বলে (Cole, 1958; Hutchinson, 1970)। শিলামণ্ডলের উর্ধ্বাংশ, প্রায় সমগ্র বারিমণ্ডল এবং বায়ুমণ্ডলের অধিকাংশ নিয়ে এই বাস্তুমণ্ডল গঠিত হয়েছে। সুতরাং জীবমণ্ডল ও বাস্তুমণ্ডল-পৃথিবীর সামগ্রিক প্রণালীর দুটি ভিন্ন অংশ কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে উভয়েই উভয়ের উপর নির্ভরশীল। বাস্তুমণ্ডলেরই একটি অংশ হল জীবমণ্ডল। পৃথিবীর যে অংশে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে তাকে জীবমণ্ডল হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ।
আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, বায়ু, মৃত্তিকা এবং জলের যে অংশ জীবের বাসস্থান রচনা করে তাকেই জীবমণ্ডল বলে। সমস্ত ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদই জীবমণ্ডলের অন্তর্গত। জীবমণ্ডলের উল্লম্ব বিস্তার (বায়ু, জল, মৃত্তিকা ও শিলাসমূহ) প্রায় ৩০ কিলোমিটার। জীবমণ্ডলের উর্দ্ধসীমা নির্ভর করে-অক্সিজেন প্রাপ্যতা, জলীয়বাষ্প, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ ইত্যাদি বিষয়ের উপর। সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কয়েক’শ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জীবের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। তাই এই অংশেই জীবের প্রাধান্য বেশী। তবে ১৫ কিলোমিটার উর্দ্ধেও ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। জীবমণ্ডলের নিম্নসীমা নির্ধারিত হয় অক্সিজেন ও আলোকের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে। জীবমণ্ডলের গভীরতা সাধারণত সমুদ্রখাতেই সর্বাধিক। প্রায় ৯০০০ মিটার গভীর সমুদ্রখাতেও জীবের সন্ধান পাওয়া যায়।Definition and Nature of Biosphere
this picture is taken from freepik.com
জীবমণ্ডলের গঠনগত সংস্থান (Structural Organization of Biosphere)
সমগ্র পৃথিবীর সাপেক্ষে জীবমণ্ডলকে একটিমাত্র জীবন্ত প্রণালী হিসাবে গণ্য করা যায়। পৃথিবীর সমস্ত সজীব পদার্থই এই জীবমণ্ডলীয় প্রণালী (Biological System)-র অন্তর্গত। এখন প্রশ্ন হল-জীবমণ্ডলীয় প্রণালীর উপাদানগুলি কি কি? এই উপাদানগুলি কিভাবে একত্রিত হয়েছে বা সংগঠিত রয়েছে? উপাদানগুলির প্রকৃতি ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য প্রণালীগুলির সঙ্গে এদের সম্পর্ক কি রূপ? এই প্রশ্নগুলির উত্তরের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে জীবমণ্ডলের গঠন সংক্রান্ত ধারণা নিহিত রয়েছে। এইভাবে প্রণালী বিশ্লেষণের (system analysis) দৃষ্টিকোণ থেকে জীবমণ্ডলীয় প্রণালীর অনুপুঙ্খ পর্যালোচনার মাধ্যমেই জীবমণ্ডলের গঠনগত সংস্থান সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব।Definition and Nature of Biosphere

পৃথিবীতে প্রায় ৪ মিলিয়ন জীবের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। আবার প্রজাতির সংখ্যাও যথেষ্ট বেশী। তাই উপরোক্ত প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কেননা, জীবমণ্ডলের গঠন অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। কিন্তু এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলি সরলতম জীব থেকে জটিলতম জীব পর্যন্ত সমস্ত ধরনের জীবেই বর্তমান। এরকমই একটি বৈশিষ্ট্য হল কোষের উপস্থিতি।
কোষ হল সরলতম এবং স্বাধীনসত্তাবিশিষ্ট এমন এক সংস্থান যা জীবের প্রায় সমস্ত প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলির ধারক। সুতরাং জীবমণ্ডলের গঠনগত সংস্থান বিশ্লেষণে কোষের গঠন এবং ক্রিয়াশীলতা আলোচনা করা জরুরী। জীবমণ্ডলীয় প্রণালীর গঠনগত এবং কার্যগত একক হল কোষ। কতকগুলি কোষের সমন্বয়ে গঠিত হয় কলা, কতকগুলি কলার সমন্বয়ে গঠিত হয় অঙ্গ এবং কতকগুলি অঙ্গের সম্মিলনে একটি জীবদেহ গঠিত হয়। এভাবেই জীব, জীব জনসংখ্যা (population), জীবগোষ্ঠী (community), ইত্যাদি জীবমণ্ডলের ক্রমোর্দ্ধ স্তরগুলি গঠন করেছে। তাই জীবমণ্ডলের গঠনগত সংস্থান সংক্রান্ত আলোচনা কোষীয় স্তর (cellular level) থেকেই শুরু করা প্রয়োজন।Definition and Nature of Biosphere
জীবন রসায়ন (Chemistry of Life)
কোষ হল কতকগুলি সরল এবং জটিল আণবিক গঠন সম্পন্ন যৌগের সমন্বয় জীবমণ্ডলের গঠনগত বিশ্লেষণে যে কতকগুলি গঠন সম্পর্কিত স্তর পাওয়া যায় তারই টি ভিন্ন স্তরে কোষ এবং জীবের অবস্থান। শিলামণ্ডল, ারিমণ্ডল বা বায়ুমণ্ডল যে সমস্ত উপাদানে গঠিত, জীবমণ্ডলও সেই সমস্ত উপাদানেই গঠিত। তবে জীবমণ্ডলে কতকগুলি উপাদানের পরিমাণ অন্যান্য মণ্ডলগুলির তুলনায় অধিক (যেমন কার্বন), আবার কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান খুবই অল্প পরিমানে উপস্থিত (যেমন-সিলিকন)। এ কারণেই জীবমণ্ডল অন্যান্য মণ্ডলগুলির তুলনায় পৃথকধর্মী। এই সমস্ত উপাদানগুলি পরস্পর রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়ে কয়েকটি অজৈব যৌগ (সাধারণত দ্রবণে আয়নিত অবস্থায় থাকে) এবং কতকগুলি জৈব যৌগ গঠন করে। এই যৌগগুলি (জৈব এবং অজৈব) সম্মিলিতভাবে জীবমণ্ডল গঠন করেছে। Definition and Nature of Biosphere
কার্বন সমন্বিত যৌগগুলি মূলত জৈবযৌগ। এই জৈব যৌগগুলি খুবই সূক্ষ্মভাবে এবং জটিল আকারে বিন্যস্ত থাকে, যা অজীবীয় প্রণালীতে অনুপস্থিত। জৈবযৌগগুলিতে কার্বন ছাড়াও হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন উপস্থিত থাকে। জীবকোষে উপস্থিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরল জৈব যৌগগুলি হল-ফ্যাটি অ্যাসিড, মনোস্যাকারাইড, মনোনিউক্লিওটাইডস্, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং’ হেটেরোসাইক্লিক ক্ষারসমূহ (heterocyclic bases)। এই সরল জৈবযৌগগুলি আবার পুনর্বিন্যস্ত হয়ে লিপিড (ফ্যাট), পলিস্যাকারাইড (শর্করা, স্টার্চ, সেলুলোজ), নিউক্লিক অ্যাসিড, (Ribo Nucleic Acid, Deoxyribose Nucleic Acid) এবং প্রোটিন গঠন করে। সুতরাং কোষের আণবিক গঠন ত্রিস্তরীয়।
প্রথম স্তর-মনোমার (Monomer) গুলি (শর্করা, অ্যামিনো অ্যাসিড বা নিউক্লিওটাইড)
শৃঙ্খলিতভাবে বিন্যস্ত থাকে।
দ্বিতীয় স্তর-মনোমার শৃঙ্খলগুলি সর্পিলাকারে বিন্যস্ত থাকে। (যেমন-প্রোটিন)।
তৃতীয় স্তর-বিভিন্ন মনোমার শৃঙ্খল পরস্পর একত্রিত হয়ে ত্রিমাত্রিক বিন্যাস গঠন করে। এইভাবে গঠিত বৃহৎ অণুগুলিকে ম্যাক্রো অণু (Macro molecule) বলে। বিভিন্ন ম্যাক্রো অণুগুলির গঠনগত বিন্যাস পৃথক হয়। এ কারণে কোষে এদের কার্যকারিতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। Definition and Nature of Biosphere
কোষস্তরীয় গঠন (Structure at Cellular Level)
আকৃতি, আয়তন এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোষগুলি পরস্পর পৃথকধর্মী। কিন্তু তা হলেও কতকগুলি একই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রায় সমস্ত কোষেই দেখা যায়। আণবিক স্তর থেকে শুরু করে কোষীয় স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন গাঠনিক স্তরগুলি প্রদর্শিত হয়েছে। কোষত্ব উপাদানগুলিকে মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। (ক) সাইটোপ্লাজম-এটি একটি সান্দ্রা তরল যা প্রধানত জল দ্বারা গঠিত এবং অজৈব আয়ন সমৃদ্ধ। সরল বা জটিল জৈব ম্যাক্রো অণুগুলি প্রলম্বিত (suspended) অবস্থায় সাইটোপ্লাজমে অবস্থান করে।
সাইটোপ্লাজমীয় ধাত্রে (matrix) কোষস্থ অঙ্গাণুগুলি (subcellular organells) (যেমন-কোষ মেমব্রেন, রাইবোজোম, গলগিবস্তু ইত্যাদি) থাকে। ম্যাক্রো অণুগুলি বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে এই কোষস্থ অঙ্গাণুগুলি গঠন করে। এগুলিকে এক একটি জৈব রাসায়নিক প্রকোষ্ঠ (compartment) হিসাবে বিবেচনা করা যায়। (খ) নিউক্লিয়াস বা.কেন্দ্রক- এটি কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি নিউক্লিক অ্যাসিড ও নিউক্লিও প্রোটিন দ্বারা গঠিত।Definition and Nature of Biosphere
কোষের কার্যকরী সংস্থান ও ক্রিয়াকলাপ (Functional Organization & Activities of Cell)
কোষ মূলত শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে। কোষে সাধারণত তিন ধরনের কার্য হয়ে থাকে।
ক) রাসায়নিক কার্য:
নতুন কোষের সৃষ্টি ও কোষের পরিপোষণের জন্য কোষ কতকগুলি প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করে। এই প্রক্রিয়াকে জৈব সংশ্লেষ বলে (Biosynthesis) বলে।
(খ) পরিবহণ কার্য:
পরিবহণক্ষম কোষীয় পদার্থ কোষের একস্থান থেকে অন্যস্থানে বা কোষের বাইরে পরিবাহিত হয়।
(গ) যান্ত্রিক কার্য:
প্রাণীদেহের পেশীকোষগুলিতে এ ধরনের কার্য অধিক পরিলক্ষিত হলেও অন্যান্য কোষেও এরূপ কার্য সম্পাদিত হয়।Definition and Nature of Biosphere

Definition and Nature of Biosphere
কোষে পদার্থ ও শক্তির স্থানান্তরণ (Transfer of Matter and Energy in the Cell)
কোষের শক্তি নিহিত থাকে কতকগুলি জটিল অণু যেমন-কার্বহাইড্রেট (শর্করা, গ্লাইকোজেন), ফ্যাট বা লিপিড ইত্যাদির মধ্যে। এগুলি কোষের একটি বিশেষ অঞ্চলে (মাইটোকনড্রিয়া) সঞ্চিত থাকে। এদের জ্বালানী অণু (fuel molecules) বলে। এই জ্বালানী অণুর জারণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয় তা ADP (Adenosine disphosphate) (কোষস্থ একটি যৌগ)-কে ATP (Adenosinetriphosphate) নামক অপর একটি যৌগে পরিণত করে। অর্থাৎ ADP শক্তিবিহীন স্তর ও ATP শক্তিসমৃদ্ধ স্তর নির্দেশ করে।
কোষীয় শ্বসনের মাধ্যমে জ্বালানী অণু থেকে শক্তি নির্গত হয়ে থাকে। অক্সিজেন হল শ্বসন প্রক্রিয়ার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। শ্বসনের ফলে শক্তি ছাড়াও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জল উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত সমস্ত শক্তিই ADP কর্তৃক গৃহীত হয় না, কিছু অংশ শ্বসন তাপ (Catabolic heat) হিসাবে নষ্ট হয়। এই অক্সিজেন যুক্ত শ্বসন প্রক্রিয়াটি কোষের মাইটোকনড্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। তাই মাইটোকনড্রিয়াকে “কোষের শক্তিঘর” (Power house of cell) বলে।Definition and Nature of Biosphere
ATP-স্থিত এই স্থৈতিক শক্তি কোষের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া, যান্ত্রিক কার্য, পরিবহণ কার্য, জৈব বা অজৈব ম্যাক্রো অণুগুলির বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। ATP থেকে শক্তি নির্গত হলে তা পুনরায় ADP-তে পরিণত হয়। এইভাবে কোষে শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নানা ধরনের কার্য সম্পাদিত হয়, যা কোষস্থ ক্রোমজোমের DNA (Deoxyribo Nucleic Acids) কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত।
কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কোষ বিভাজন। কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অনুরূপ কোষ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত কোষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং পুনর্বিভাজিত হয়। এভাবেই সমগ্র জীবমণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছে। তাপ গতিবিদ্যা (Thermodynamics)-র আলোকে বিষয়টি বিচার করলে দেখা যায় যে, কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজনের মাধ্যমে কোষ তথা সমগ্র জীবমণ্ডলীয় প্রণালীটির এনট্রপি (entropy) হ্রাস প্রাপ্ত হয়। কিন্তু তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী সামগ্রিক এনট্রপি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া উচিত। কোষের এনট্রপি হ্রাসের কারণ হল, কোষ তার চতুষ্পার্শ্বস্থ পরিবেশ থেকে জ্বালানী বা খাদ্য অণু গ্রহণ করে যার রাসায়নিক স্থৈতিক শক্তি (Chemical Potential Energy)-র পরিমাণ বেশী বা এনট্রপি কম।

কোষগুলি পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জল ও সামান্য তাপশক্তি পরিত্যাগ করে যার এনট্রপি বেশী। সুতরাং কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজনের মাধ্যমে যে সমস্ত পদার্থ পরিবেশে পরিত্যাগ করে তার এনট্রপি বেশী হওয়ায় পরিবেশের এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। তাই কোষের এনট্রপি হ্রাস পেলেও কোষ বিভাজনের ফলে কোষ-পরিবেশ প্রণালীর এনট্রপি সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সুতরাং কোষকে একটি মুক্ত প্রণালী (open system) হিসাবে গণ্য করা যায়। কারণ, কোষে বাহির থেকে জ্বালানী বা খাদ্য অণুর প্রবেশ ঘটে এবং কোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জল নির্গত হয়।-Definition and Nature of Biosphere
স্বভোজী কোষগুলি (Autotrophic Cells) বহিঃস্থ শক্তি ব্যবহার করে নিজেরাই জ্বালানী অণু বা খাদ্য অণু প্রস্তুত করতে সক্ষম। যে সমস্ত স্বভোজী কোষ অজৈব যৌগের রাসায়নিক বন্ধন শক্তি ব্যবহার করে কার্বন-ডাই-অক্সাসড থেকে জৈব যৌগ তথা খাদ্য অণু প্রস্তুত করে তাদের রাসায়নিক স্বভোজী কোষ (Chemotrophic Cells) বলে। আবার যে সমস্ত কোষ সূর্যালোক ব্যবহার করে খাদ্য অণু প্রস্তুত করে তাদের সালোক সংশ্লেষীয় কোষ (Photosynthetic Cells) বলে সালোক সংশ্লেষ হল শ্বসনের বিপরীত প্রক্রিয়া।) এক্ষেত্রে ADP, ATP-তে পরিণত হয় এবং এর ফলে উদ্ভূত শক্তি স্বভোজী কোষে কার্বহাইড্রেট ও অন্যান্য জৈব পদার্থ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সালোক সংশ্লেষে শোষিত সূর্যালোক থেকে প্রাপ্ত শক্তিই ADP কে ATP তে পরিণত করে। সৌরশক্তির শোষণ ও তার ব্যবহারে কোষের যে অংশটি (organelle) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে সেটি হল ক্লোরোপ্লাস্ট (chloroplast)।

ক্লোরোপ্লাস্টে ক্লোরোফিল (chlorophyll) নামক একটি রঞ্জক পদার্থ থাকে। ক্লোরোফিল লাল ও নীল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোক শোষণ করায় একটি সবুজ বর্ণ বিশিষ্ট হয়। এই শোষিত আলো ক্লোরোফিল অণুর এটি ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে। এই ইলেকট্রনটি ক্লোরোফিল থেকে নিঃসৃত হয় এবং বিভিন্ন অনুঘটক (catalyst) দ্বারা পরপর গৃহীত হয়। এইভাবে কতকগুলি শৃঙ্খলিত বিক্রিয়ার মাধ্যমেATP উৎপাদন করে। একে সালোক সংশ্লেষের আলোকদশা (light phase) বলে। ATP থেকে প্রাপ্ত শক্তির সাহায্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জল থেকে কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য সংশ্লেষিত হয়। একে অন্ধকার দশা (dark phase) বলে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি জৈব রাসায়নিক বিজারণ (biochemical reduction) বিক্রিয়া। এর ফলে জলের অণু থেকে আণবিক অক্সিজেন উৎপন্ন হয় । Definition and Nature of Biosphere
২.৩ জীব, জীব জনসংখ্যা এবং জীবগোষ্ঠী (Organism, Population & Community)
জীবমণ্ডলের কার্যকরী সংস্থান ও ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে এই অধ্যায়ে এ পর্যন্ত যা কিছু আলোচনা করা হল তা সম্পূর্ণভাবে কোষীয় স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে এই আলোচনা আদৌ অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ কোষের সংস্থান ও কার্যকারিতার সঙ্গে জীব, জীব জনসংখ্যা তথা জীবগোষ্ঠীর কার্যকারিতা বা ক্রিয়াশীলতার মূলগত সাদৃশ্য রয়েছে, যা জীবমণ্ডলের সামগ্রিক ক্রিয়াপ্রণালী অনুধাবনে সহায়তা করে। biosphere

এখন প্রত্যেকটি জীবকে এক একটি জীবন প্রণালী (Life System) হিসাবে গণ্য করা যায়। এরা প্রত্যেকেই তাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ অজীবীয় পরিবেশের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থাকে। এককোষী জীব যেমন-প্রোটোজোয়া, অ্যালগি ইত্যাদির ক্রিয়াপ্রণালী একটি সাধারণ কোষের ক্রিয়াপ্রণালীর তুলনায় ভিন্নধর্মী। বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে, গঠন ও কার্যকারিতার দিক থেকে বিশেষধর্মী কোষগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত কলা গঠন করে। কলাগুলি সম্মিলিতভাবে অঙ্গ (organ) গঠন করে। অনুরূপভাবে অঙ্গ গুলির সমন্বয়ে অঙ্গ প্রণালী (organ system) এবং অঙ্গপ্রণালীর সমন্বয়ে একটি জীব গড়ে ওঠে (চিত্র নং ২.২)। প্রত্যেক জীব তার চারিপাশের অজীবীয় পরিবেশের সঙ্গে শক্তি ও পদার্থ বিনিময় করে (খাদ্যগ্রহণ ও বর্জ্য পদার্থ পরিত্যাগের মাধ্যমে) এবং এইভাবে জীবটি তার পরিবেশের সাথে কার্যকরী সম্পর্ক গড়ে তোলে।
২.৩.১ প্রজাতি ও জীব-জনসংখ্যা (Species & Population)
ভূ-পৃষ্ঠে অসংখ্য জীব বাস করে এবং প্রত্যেকটি জীব কোনও না কোনও দিক থেকে অপর যে কোনও জীব থেকে পৃথকধর্মী। একই বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীবগুলিকে একই প্রজাতিভুক্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। একই প্রজাতিভুক্ত সমস্ত জীব সম্মিলিতভাবে জীব জনসংখ্যা গঠন করে। প্রত্যেকটি জীব জনসংখ্যা প্রজননগতভাবে এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অন্য জীব জনসংখ্যা থেকে পৃথক। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৪,০০,০০০ উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। biosphere
প্রাণী জগতেও প্রায় ১০ লক্ষ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৮ লক্ষ ৫০ হাজারটি কীট-পতঙ্গ শ্রেণীভুক্ত। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ৪০০০ প্রজাতি, পাখীদের মধ্যে প্রায় ৮০০০ প্রজাতি এবং প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৎস্য রয়েছে। আবার সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের মধ্যে প্রায় ৬,০০০ প্রজাতি আছে। এ সমস্ত প্রজাতিই বিবর্তনের ফল। কোষস্থ ক্রোমোজোমের DNA মারফৎ বংশগতির সংকেত সমূহের পরিবহণ এবং ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবেশ কর্তৃক নির্বাচন-এই দুই প্রক্রিয়ায় সম্মিলিত ফল হিসাবে প্রজাতির সৃষ্টি হয়।

জীবদেহের বিপাকক্রিয়া, বৃদ্ধি, বিকাশ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই বংশগতি নিয়ন্ত্রিত। তাই জীবদেহের শারীরবৃত্তীয় গঠন, অঙ্গসংস্থান, ক্রিয়াশীলতা, আচরণ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হয়। ফলে একই জীব জনসংখ্যার অন্তর্গত বিভিন্ন জীবগুলি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়ে থাকে। যে সমস্ত জীবগুলির বৈশিষ্ট্য স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অস্তিত্ব রক্ষার উপযোগী সেই জীবগুলি প্রকৃতি কর্তৃক নির্বাচিত হয় অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে টিকে থাকে। বাকী জীবগুলি অভিযোজনগত অক্ষমতার কারণে পৃথিবী থেকে অপসৃত হয়। এইভাবে একটি দীর্ঘকালীন বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান প্রজাতিগুলির সৃষ্টি হয়েছে। বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিসরণ (dispersion) এবং স্থানান্তরণের (migration) মাধ্যমে প্রজাতিগুলি ভূ- পৃষ্ঠে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে জীবের বন্টন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। তাই পৃথিবীর যে কোন অংশেই নানা ধরনের প্রজাতির সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। তবে একথাও স্মরণযোগ্য যে, প্রজাতিগুলির বিবর্তন, বিসরণ, স্থানান্তরণ ইত্যাদি বিষয়ই যে কেবলমাত্র প্রজাতির বন্টনে প্রভাব বিস্তার করে তা নয়। জলভাগ স্থলভাগের বণ্টন, জলবায়ুগত পরিবর্তন, পর্বত সমূহের উত্থান, হিমক্ষেত্রের অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণ ইত্যাদি বিষয়গুলিও প্রজাতির বণ্টনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। biosphere
২.৩.২ জীবগোষ্ঠী, জীবমণ্ডল, বাস্তুতন্ত্র এবং বাস্তুমণ্ডল (Community, Biosphere, Ecosystem and Ecosphere)
ভূ-পৃষ্ঠের কোনও স্থানেই উদ্ভিদ বা প্রাণীজগৎ একটিমাত্র প্রজাতি নিয়ে গড়ে ওঠে না। অর্থাৎ কোনও স্থানে একটিমাত্র জীব জনসংখ্যা বিশুদ্ধভাবে অবস্থান করে না। সাধারণত বিভিন্ন জীব জনসংখ্যাগুলি একত্রে একটি জীবগোষ্ঠী হিসাবে অবস্থান করে। কতকগুলি জীব জনসংখ্যার সম্মিলনে একটি জীবগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। একটি জীবগোষ্ঠীতে যথেষ্ট বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। জীবগোষ্ঠীগুলি বিভিন্ন বিস্তৃতি সম্পন্ন হতে পারে। যেমন-একটি পুষ্করিণীর জীবগোষ্ঠী, আবার আমাজন অববাহিকার বৃষ্টি অরণ্যের জীবগোষ্ঠী। জীবের ন্যায় জীবগোষ্ঠীও তার পরিবেশের সঙ্গে অবিরাম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে অভিযোজিত করে এবং এইভাবে জীবগোষ্ঠীটি নিজস্ব পরিবেশকে প্রতিফলিত করে থাকে। জীবগোষ্ঠীর অভিযোজন হল এককভাবে প্রতিটি জীবের অভিযোজনের সামগ্রিক ফল। কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবগোষ্ঠীর অভিযোজন অনেক উচ্চ স্তরের। পরিবেশের সঙ্গে সমগ্র জীবগোষ্ঠীর এই অভিযোজন জীবগোষ্ঠীটির গঠন এবং কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে। biosphere

ভূ-পৃষ্ঠে যতগুলি জীবগোষ্ঠী বর্তমান তাদের একত্রে জীবমণ্ডল বলে। কোষ, জীব, জীব জনসংখ্যা, জীবগোষ্ঠী-এই ক্রমান্বয়িক শ্রেণী (series)-এর সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংগঠন হল জীবমণ্ডল (চিত্র ২.৫)। জীবমণ্ডলের সাথে অজীবীয় পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে প্রণালীটি গড়ে ওঠে, তাকে বাস্তুমণ্ডল বলে। আবার জীবগোষ্ঠী স্তরে (community level) জীবগোষ্ঠী ও পরিবেশের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাস্তুতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। গঠনের দিক থেকে সমধর্মী বাস্তুতন্ত্রগুলির একই পরিবেশে সমাবেশ ঘটলে তাদের সংস্থানটিকে বায়োম (Biome) বলে।
২.৪ জীবমণ্ডলের কার্যকারিতা মডেল (Functional Model of the Biosphere)

২.৪.১ শক্তির পরিবহণ (Transfer of Energy)
পৃথিবীতে জীব এবং জীবগোষ্ঠীগুলির মধ্যে যথেষ্ট বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকলেও জীবমণ্ডলের কার্যকারিতার একটি মডেল উপস্থাপন করা সম্ভব। কারণ, পরিবেশের সাথে শক্তি ও পদার্থের আদান- প্রদান, শক্তি পরিবহণের প্রক্রিয়া ও গতিপথ ইত্যাদি বিষয়ে সমস্ত জীব, জীবগোষ্ঠী বা জীবমণ্ডল সমধর্মীতা প্রদর্শন করে। উদ্ভিদ দেহের বেশীরভাগ অংশই স্বভোজী কোষ দ্বারা গঠিত এবং প্রাণীদেহ (ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে) মূলত পরভোজী কোষের সমন্বয়ে গঠিত। সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত হয়। এই রাসায়নিক শক্তি কার্বহাইড্রেট অণুতে সঞ্চিত থাকে। শ্বসনের মাধ্যমে এই শক্তি ATP-তে স্থানান্তরিত হয়। ATP-তে অবস্থিত শক্তি জৈবসংশ্লেষে ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে সালোক সংশ্লেষের মাধ্যমে উৎপন্ন খাদ্য অন্যত্র পরিবাহিত হয় এবং তাতে নিহিত শক্তি সালোক সংশ্লেষে অক্ষম কোষগুলি কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরভোজী প্রাণী খাদ্যের মাধ্যমে সালোক সংশ্লেষে উৎপাদিত খাদ্য এবং উদ্ভিদের জৈব সংশ্লেষের ফলে গঠিত পদার্থসমূহকে গ্রহণ করে। biosphere

সুতরাং জীব এবং জীবগোষ্ঠীর কার্যকারিতার সংস্থানটি ক্রমান্বয়িক (hierarchical)। সবুজ উদ্ভিদ ক্লোরোফিলের উপস্থিতিতে সালোক সংশ্লেষের মাধ্যমে সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং খাদ্যে আবদ্ধ করে। এই শক্তি প্রথমে তৃণভোজী প্রাণী ও পরে মাংসাশী প্রাণীতে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। এই ক্রমান্বয়িক সংস্থানকে খাদ্যশৃঙ্খল (Food Chain) বলে (Lindeman, 1942) খাদ্যশৃঙ্খলের একই ক্রমে অবস্থানকারী সমস্ত জীবগুলি একই খাদ্যস্তর (Trophic Level) ভুক্ত। একটি খাদ্যস্তর থেকে পরবর্তী খাদ্যস্তরে পরিবাহিত হওয়ার সময় কিছু পরিমাণ শক্তি নষ্ট হয়। এই শক্তি পূর্ববর্তী খাদ্যস্তরের কোষীয় কার্যাবলীর সাথে সম্পর্কিত শ্বসন তাপকে নির্দেশ করে। biosphere
জীবমণ্ডলে আরও এক ধরনের জীব বাস করে, যাদের শক্তির উৎস হল মৃত উদ্ভিদ বা প্রাণীর কলাস্থিত বা বর্জ্য পদার্থে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তি। এদের বিয়োজক (Decomposer) বলে। এরা পচনশীল জৈব পদার্থকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। ব্যাকটেরিয়া, ফাংগি ইত্যাদি এ ধরনের জীবের উদাহরণ। সুতরাং জীবমণ্ডলে শক্তিপ্রবাহ দুটি ভিন্ন পথে সংঘটিত হয়ে থাকে-চারণ খাদ্যশৃঙ্খল(Grazing Food Chain) অথবা অবশেষ খাদ্যশৃঙ্খল (Detritus Food Chain)-এর মাধ্যমে।
প্রত্যেক খাদ্যস্তরেই সাময়িকভাবে কিছু পরিমাণ স্থৈতিক রাসায়নিক শক্তি (Potential Chemical Energy) সঞ্চিত থাকে। প্রত্যেক স্তরেই খাদ্যের পরিপাক, আত্মীকরণ, পরিপোষণ, জৈবিক কার্যাবলী, বৃদ্ধি এবং প্রজননের প্রয়োজনে কিছু পরিমাণ স্থৈতিক শক্তি তাপশক্তি হিসাবে ব্যয়িত হয়। কয়েক বছর পরে প্রতিটি খাদ্যস্তরে গৃহীত শক্তি (input) পরিত্যক্ত শক্তি (output)-র পরিমাণের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়। এই দুই-এর বিয়োগফলই হল ঐ স্তরে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যা উক্ত স্তরের জীবভর (Biomass)-এর পরিবর্তন ঘটায়। biosphere
২.৪.২ পদার্থের পরিবহণ (Transfer of Matter)
শক্তির পরিবহণের সাথে সাথে জীবমণ্ডলে পদার্থের পরিবহণও চলতে থাকে। এই নিরিখে জীবমণ্ডল-শিলামণ্ডল, বারিমণ্ডল ও বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সম্পর্কিত। জীব সাধারণত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় কার্বহাইড্রেটে স্থানান্তরিত হয় এবং জল থেকে অক্সিজেন মুক্ত হয়। স্বভোজী জীব থেকে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন খাদ্যশৃঙ্খল অনুসরণ করে পরভোজী জীবে নীত হয়। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি দ্রবীভূত আয়ন হিসাবে উদ্ভিদ কর্তৃক গৃহীত হয় এবং জৈব সংশ্লেষের মাধ্যমে জৈব অণুর পারমাণবিক উপাদান হিসাবে উদ্ভিদ কলায় অবস্থান করে। পরে পরভোজী জীব যখন উদ্ভিদগুলিকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে তখন এই উপাদানগুলি প্রাণীদেহে স্থানান্তরিত হয়।

উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রকৃতি থেকে যে সমস্ত উপাদান আহরণ করে সেগুলিকে পুনরায় পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। শ্বসনের মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং সালোক সংশ্লেষের মাধ্যমে অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে মুক্ত হয়। যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়াগুলি শ্বসনকার্যে অক্সিজেনের পরিবর্তে নাইট্রেট এবং সালফেট ব্যবহার করে তারা যথাক্রমে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন-ডাই-সালফাইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মুক্ত করে। বর্জ্য পদার্থ হিসেবেও জীব কিছু পরিমাণ জৈব ও অজৈব উপাদান পরিত্যাগ করে। মৃত জীবদেহের বিয়োজন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জীবদেহের কিছু পরিমাণ অজৈব উপাদান পরিবেশে ফিরে আসে। সেগুলি পুনরায় জীবমণ্ডলে আবর্তিত হয়। মৃত জৈব অবশেষের কিছু অংশ পচনরোধী হয়ে ওঠে ও জৈব অবক্ষেপ হিসেবে পরিবেশে সঞ্চিত হয়। জৈব অবশেষের বেশীরভাগই বিয়োজক সমূহের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। biosphere
জীবমণ্ডল জীবন ধারণের উপযোগী বেশীরভাগ উপাদানই মৃত্তিকা থেকে সংগ্রহ করে এবং মৃত্তিকাতেই ফিরিয়ে দেয়। কেবলমাত্র সালোক সংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও শ্বসনের জন্য আবশ্যিক অক্সিজেন বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রহণ করে এবং এই উপাদানগুলিকে পুনরায় বায়ুমণ্ডলেই ফিরিয়ে দেয়। জলজ জীব তাদের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি জল থেকে আহরণ করে ও জলেই বর্জন করে। যদি মৃত্তিকা বা জল থেকে উপাদান আহরণের হার এবং পচনের মাধ্যমে এই সমস্ত উপাদান বর্জনের হার-এই দুই প্রকার হারের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে জীবমণ্ডলে শক্তি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উক্ত উপাদানগুলি চক্রাকারে আবর্তিত হয়। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে কোনও কোনও উপাদানের বর্জন হার বিশেষ পরিস্থিতিতে হ্রাস পায়। এর ফলে শক্তিপ্রবাহ ব্যাহত হয়। তখন জীবমণ্ডলের উৎপাদনশীলতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়।
জীবমণ্ডলীয় প্রণালী এবং তার পরিবেশের মধ্যে পদার্থের এই পরিবহণ একটি চক্রাকার পথে সংঘটিত হয়। পদার্থ বা উপাদানগুলি বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল ও শিলামণ্ডলের মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হয়ে জীবমণ্ডলে ফিরে আসে এবং পুনরায় জীবমণ্ডল থেকে উক্ত মণ্ডলগুলিতে স্থানান্তরিত হয়। যে সমস্ত প্রক্রিয়াগুলি শক্তি পরিবহণে ক্রিয়াশীল থাকে সেই প্রক্রিয়াগুলিই প্রকৃতপক্ষে পদার্থ পরিবহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে থাকে। এই প্রক্রিয়াগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যে সমস্ত প্রক্রিয়ার শেষে সংশ্লিষ্ট পদার্থসমূহ উচ্চতর শক্তিস্তরে (রাসায়নিক বা স্থৈতিক) উন্নীত হয় সেইসব প্রক্রিয়াগুলিকে শক্তিগ্রাহী (Endergonic) প্রক্রিয়া বলে। biosphere
বিপরীতক্রমে, যে সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পদার্থসমূহ নিম্নতর শক্তিস্তরে নীত হয় সেগুলিকে শক্তি উৎপাদী (Exergonic) প্রক্রিয়া বলা হয়। বাস্তুমণ্ডলের নিরিখে এই প্রক্রিয়াগুলির হার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই হারের উপর পদার্থ পরিবহণের গতি নির্ভর করে। কোনও কোনও প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পাদিত হয় আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগুলি সম্পাদনে কয়েক হাজার লক্ষ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়। যেমন-জলের বাষ্পীভবন একটি অত্যন্ত দ্রুত প্রক্রিয়া, কিন্তু সমুদ্র অবক্ষেপগুলির গুরুমণ্ডলে নিমজ্জন একটি ধীর প্রক্রিয়া। দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পরিবহণ পথের কোনও নির্দিষ্ট অংশে পদার্থের স্থায়ীত্ব সময় (residence time) অনেক দীর্ঘ হয়ে থাকে।
নিম্নতর শক্তিস্তরের কোনও পদার্থের উচ্চতর শক্তিস্তরে স্থানান্তরণের সময়ে একটি শক্তি উৎসের প্রয়োজন হয়। বিকিরিত সৌরশক্তি, ভূ-গর্ভস্থ তাপ ইত্যাদি এরূপ শক্তির উৎসরূপে কাজ করে থাকে। biosphere
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, জীবমণ্ডলকে একটি মুক্ত প্রণালী হিসাবে বিবেচনা করা যায়। জীবমণ্ডলের প্রকৃতি, শক্তি ও পদার্থের স্থানান্তরণ প্রক্রিয়া ও গতিপথের উপর নির্ভরশীল। তবে বাস্তুমণ্ডলের প্রকৃতি নির্ধারণে জীবমণ্ডলস্থিত জীবগুলির ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-উদ্ভিদের প্রকৃতির উপর মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য নির্ভরশীল। সুতরাং জীবমণ্ডলের জীবসমূহ যে পরিবেশে বাস করে সেই পরিবেশ রচনায় তাদের নিজেদের ভূমিকা কোনও মতেই উপেক্ষা করা যায় না।